পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের অধীন বুড়িগোয়ালিনী স্টেশনের কাছেই বনবিভাগের উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে কলাগাছিয়া ইকো- টু্যরিজম কেন্দ্র। সুন্দরবনের পরিবেশকে ঠিক রেখে পর্যটকদের বন ভ্রমণের জন্য নানান সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি বন্যপ্রাণী দেখারও ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। যারা মংলার কাছে করমজল ইকো-টু্যরিজম কেন্দ্র দেখেছেন, এ জায়গাটি তাদের কাছে আরো বেশি সাজানো-গোছানো ও সুন্দর মনে হবে।
ইকো-টু্যরিজম কেন্দ্রের জেটি বেয়ে উপরে উঠে একটু সামনেই এর প্রবেশপথ। শুরুতেই গোলাকার বিশ্রাম ছাউনি হাতের বাঁয়ে রেখে ইট বাঁধানো সরু পথে চলতে চলতে ছোট কাঠের সেতুটি পেরিয়ে শুরু হয়েছে ঘন জঙ্গলের ভেতরে দীর্ঘ কাঠের তৈরি হাঁটাপথ (ওয়াকওয়ে)। দু'পাশে গরান আর খাইলশা গাছের প্রাধান্যই বেশি। এ সময়ে (এপ্রিল, মে) এ দুই ধরনের গাছ থাকে ফুলে ফুলে ভরা। এ পথে হাঁটতে তাই নাকে ছোঁয়া দিয়ে যাবে বনফুলের সুগন্ধি। কাঠের সেতুর নিচে জোয়ার-ভাটায় ভেজা মাটিতে গজিয়ে ওঠা লাখো শ্বাসমূল ভাটার সময় দেখা গেলেও জোয়ারের সময় ডুবে থাকে জলের নিচে। বনের মধ্যে অাঁকাবাঁকা ওয়াকওয়ে ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখা মিলতে পারে নানান পাখি, বন মোরগ, বানর, হরিণ কিংবা অন্যকোনো বন্যপ্রাণী। এদের কতটা দেখা মিলবে তা কিন্তু নির্ভর করবে আপনার উপরেই। সামান্যতম হৈচৈ কিংবা উচ্চস্বরে কথাবার্তা বন্যপ্রাণীদের খুবই বিরক্ত করে। শুধু তাই নয়, এখানে কিন্তু মামাও (বাঘ) আসেন মাঝে মধ্যে। তাকে দেখা কিন্তু ভাগ্যের ব্যাপার!
কাঠের সেতুটি যেখানে শেষ, তার একটু আগেই হাতের বাঁ দিকে রয়েছে একটি মিঠাজলের পুকুর। এখানে বন্যপ্রাণীরা বিশেষ করে বানর, হরিণের দল জলপানে আসে। এ রকম আরো একটি পুকুর আছে এ ভ্রমণ কেন্দ্রের একেবারে শুরুতে, হাতের ডানে। এখানেও এরা পানি খেতে আসে।
কাঠের সেতুর শেষে ইট বাঁধানো সরু পথটি চলে গিয়েছে দু'দিকে। সোজা পথটি গেছে একেবারে প্রবেশ পথের দিকে। আর ডানের সরু পথটি চলেছে বনের মধ্য দিয়ে বিশ্রাম ছাউনির দিকে। ঘুরে ঘুরে তাই বিভিন্ন পথে দেখা যায় এ জায়গাটিকে। পথ হারানোরও ভয় নেই। পথটি এসে শেষ হয়েছে শুরুর স্থানেই। তা ছাড়াও দুজন বনরক্ষীও আছে এখানে।
একটি মজার ব্যাপার হলো, কলাগাছিয়ার বনকমর্ীদের সঙ্গে এখানকার বন্যপ্রাণীদের সখ্যতাও বেশ ভালো। তবে, এদের সবচেয়ে বেশি ভাব এখানকার ইঞ্জিন নৌকা চালক মজিবর রহমানের সঙ্গে। খাবার নিয়ে ডাকলে বানর আর হরিণেরা ছুটে আসে তার কাছেই। বাঘ কখনো এখানকার কাছাকাছি চলে এলে বিপদ সংকেতও জানায় এখানকার চতুর বানররা।
কলাগাছিয়া ইকো-টু্যরিজম কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে আছেন আবু তারেক খন্দকার। তার থেকে জানা গেল, ইকো-টু্যরিজম কেন্দ্রটি এখনো তৈরি হচ্ছে। পর্যটকদের সুবিধার জন্য নানান সুযোগ-সুবিধাও যোগ করা হচ্ছে। পর্যটকরা যাতে সহজেই নদী থেকে এখানে উঠতে পারেন, সেজন্য জেটির স্থলে বনবিভাগ একটি গ্যাঙ্গওয়ে পল্টুন স্থাপন করবে শিগগিরই। এ ছাড়া ইকো-টু্যরিজম কেন্দ্রের শুরুতেই একটি হরিণ ও শাপের প্রজনন কেন্দ্র করা হবে।
কিভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে বাসে সাতক্ষীরা কিংবা শ্যামনগর। ঢাকার গাবতলী ও কল্যাণপুর থেকে সরাসরি সাতক্ষীরা যায় এসপি গোল্ডেন লাইনের (০২-৮১২৪৭৯৫) মার্সিডিজ বেঞ্জ এসি বাস, ভাড়া ৬০০ টাকা। এ ছাড়া হানিফ এন্টারপ্রাইজ (০২-৯১৩৫০১৮), সোহাগ পরিবহন (০২-৯৩৩৪১৫২), সাতক্ষীরা এক্সপ্রেস (০১৭১২৭৮৭৩৬০), এসপি গোল্ডেন লাইন (০১৭৪০৯৪৯৬৪১), সাতক্ষীরা কে লাইন, সাতক্ষীরা ট্রাভেলস প্রভৃতি পরিবহন সংস্থার নন এসি বাস চলে ঢাকা-সাতক্ষীরা পথে। ভাড়া ২৫০-৩০০ টাকা। সাতক্ষীরা কিংবা শ্যামনগর থেকে বাসে মুন্সীগঞ্জ এসে সেখান থেকে ভটভটি, রিকশায় আসতে হবে বুড়িগোয়ালিনী ফরেস্ট স্টেশনে। সেখান থেকে বন বিভাগের অনুমোদিত ইঞ্জিন নৌকায় আসতে হবে কলাগাছিয়া ইকো-টু্যরিজম কেন্দ্রে আসতে সময় লাগবে আধা ঘণ্টা থেকে পৌনে এক ঘণ্টা। এখানকার একেকটি নৌকায় ২০-২৫ জন একবারে যাওয়া সম্ভব। ভাড়া ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। এখানকার নৌকা চালকদের সর্দার হামিদ (০১৯১৭৬১৬৩৬৭)।
কোথায় থাকবেন
কলাগাছিয়া ইকো-টু্যরিজম কেন্দ্রটি এক দিনেই বেড়ানো সম্ভব। তা ছাড়া এখানে সাধারণ পর্যটকদের জন্য থাকারও কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই দিনে দিনেই ঘুরে আসতে হবে জায়গাটি। খুব সকালে সাতক্ষীরা থেকে গিয়ে আবার রাতে এসে তাই সেখানেই অবস্থান করা যেতে পারে। সাতক্ষীরা শহরের দু-একটি হোটেল হলো_শহরের পলাশপোল এলাকায় হোটেল সম্রাট (০৪৭১-৬৪৫৭১, এসি একক কক্ষ ৫০০ টাকা, এসি দ্বৈত ৬০০ টাকা, নন এসি একক ২০০ টাকা, নন এসি দ্বৈত ৩০০ টাকা)। হোটেল আরামবাগ (০১৭১২৭৮৭৪৮৭, নন এসি একক ১০০ টাকা, নন এসি দ্বৈত ২০০ টাকা)। শহরের বাইরে খড়িবিলা এলাকায় মোজাফফর গার্ডেন রিজর্ট (০১৭১৯৭৬৯০৯, ০১১৯১৮১২২৫৭, এসি দ্বৈত কক্ষ ১ হাজার ৫০০ টাকা, নন এসি দ্বৈত কক্ষ ১ হাজার টাকা)।
প্রয়োজনীয় তথ্য
কলাগাছিয়া ইকো-টু্যরিজম কেন্দ্র দেশি পর্যটকদের জন্য প্রবেশ মূল্য ১০ টাকা। আর বিদেশিদের জন্য ২০০ টাকা।
মনে রাখবেন
এখানে ভ্রমণের সময় সম্পূর্ণ নিরবতা অবলম্বন করলে অনেক ধরনের বন্যপ্রাণী দেখা সম্ভব। তাই, জঙ্গলে ভ্রমণের সময় কোনো রকম হৈচৈ করবেন না। জঙ্গলে কোনো রকম আগুন জ্বালানো এবং ধূমপান করা উচিত নয়। যেকোনো রকম বর্জ্য যেমন, চিপসের প্যাকেট, পেট বোতল, পলিথিন জাতীয় কিছু সঙ্গে করে এনে জঙ্গলের বাইরে কোথাও ফেলুন।