প্রাচীন জনপদের সন্ধানে Rumi, December 26, 2009 উয়ারী-বটেশ্বর নরসিংদী জেলার উয়ারী-বটেশ্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রাচীন সভ্যতার এক অনন্য নজির। নরসিংদীর বেলাব থানা থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত দুটি গ্রামের নাম উয়ারী এবং বটেশ্বর। মধুপুরগড়ের পূর্ব সীমান্তে এ গ্রাম দুটির অবস্থান। কয়রা নামে পরিচিত একটি শুষ্ক নদী উয়ারী গ্রামের উত্তরদিকে পূর্ব থেকে পশ্চিমে এখনো দৃশ্যমান। এক সময় পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র নদীটি বর্তমানে মাত্র তিন কিলোমিটার পূর্বদিক দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আড়িয়াল খাঁ যেখানে মেঘনার সঙ্গে মিলেছে সেখান থেকেও প্রতœস্থানটির দূরত্ব খুবই কম। প্রতœস্থানটি অপেক্ষাকৃত উঁচু ভূমিতে অবস্থিত হওয়ায় বন্যার কবল থেকে এক রকম মুক্তই বলা যাবে। এই উয়ারী-বটেশ্বরেই বাস করতো প্রাচীন সেই গঙ্গারিডি জাতি। এ জাতির অনেক অজানা ইতিহাস লুকিয়ে আছে মাটির নিচে। সেই লুকিয়ে থাকা সম্ভাবনাকে বের করে আনতে কাজ করে যাচ্ছেন পুরনোদের সঙ্গে নতুনরাও। উয়ারী-বটেশ্বর প্রায় আড়াই হাজার বছর বা তার চেয়ে বেশি সময়ের প্রাচীন একটি দুর্গ-নগরী। সম্প্রতি মনে করা হচ্ছে, উয়ারী-বটেশ্বর গ্রিক ভূগোলবিদ টলেমি বর্ণিত বাণিজ্য-কেন্দ্র সৌনাগড়া। প্রাচীন বাণিজ্যের ইতিহাস জানতে উয়ারী-বটেশ্বর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে অ্যাগেট, চ্যালসেডনি, জেসপার, কোয়ার্টজ, অ্যামেথিস্ট প্রভৃতি স্বল্প মূল্যবান পাথরের পুঁতি, মন্ত্রপুত কবচ প্রভৃতি। এসব স্বল্প মূল্যবান পাথরের কাঁচামাল বাংলাদেশ ভূখ-ে পাওয়া যায় না। এগুলো অবশ্যই বহির্বিশ্ব থেকে এ দেশে এসে থাকবে। সুন্দর সুন্দর স্বল্প মূল্যবান পাথরের পুঁতিগুলো এখানে তৈরি হয়েছিল তার প্রমাণও পাওয়া গিয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে, আড়াই হাজার বছর আগে এখানে পুঁতি তৈরির দক্ষ কারিগর ছিল। কাচের পুঁতিগুলোও চমকপ্রদ। এছাড়া উয়ারী-বটেশ্বরে পাওয়া গিয়েছে শুধু বাংলাদেশ নয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম মুদ্রা ‘ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রা’। উয়ারী-বটেশ্বরে নগরায়ন মাটির নিচে লুকিয়ে আছে উয়ারী-বটেশ্বর প্রতœস্থল। তাই এ মুহূর্তে উয়ারী-বটেশ্বরে নগরায়ন ঘটেছিল তার প্রমাণ হাজির করা কঠিন বটে। ইতিমধ্যে মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধান ও প্রতœতাত্ত্বিক খননে যেসব আলামত আবিষ্কৃত হয়েছে তাতে প্রমাণিত হচ্ছে উয়ারী-বটেশ্বরে প্রাচীনকালে সমৃদ্ধ নগর সভ্যতা ছিল। আধুনিক গবেষকরা নগরের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন। গর্ডন চাইল্ডের মতে, বিভিন্ন সৌধ, ঘনবসতিপূর্ণ বিস্তীর্ণ এলাকা, খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন শ্রেণী (শাসক, বণিক, কারিগর) এবং শিল্প-সাহিত্য ও বিজ্ঞানচর্চা ইত্যাদি নগর-বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য। দিলীপ কুমার চক্রবর্তীর মতে, কেবল বাণিজ্যই নগর-বিকাশের একক-নির্ণায়ক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। নগরায়নের সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতাও অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। তবে বিভিন্ন নগর অভিন্ন কারণে নয়, বিভিন্ন বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বিকশিত হয়েছে। কোথাও মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে কৃষি, কোথাও ব্যবসা-বাণিজ্য, কোথাও নিহিত ছিল অন্য কোনো কারণ; কোথাও হয়তো কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্মিলিতভাবে নগর বিকাশকে অনিবার্য করে তুলেছে। প্রাচীনকালে উয়ারী-বটেশ্বরে যে নগরায়ন ঘটেছিল তার বেশক’টি প্রমাণ দাঁড় করানো সম্ভব। প্রথমত, বাণিজ্য-কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত নদী তীরবর্তী উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলটির পাশ দিয়ে প্রবহমান ব্রহ্মপুত্র নদ হয়ে বঙ্গোপসাগরের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে সুদূর রোমান সাম্রাজ্য পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্য চলতো। দ্বিতীয়ত, সাম্প্রতিক প্রতœতাত্ত্বিক খননে আবিষ্কৃত এখানকার প্রশস্ত রাস্তা, পার্শ্ব রাস্তা, স্থাপত্য উয়ারীর উন্নত নগর পরিকল্পনার পরিচায়ক। তৃতীয়ত, এখানে পাওয়া ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রা ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি কেন্দ্র হিসেবে উয়ারী-বটেশ্বরকে শনাক্ত করে। চতুর্থত, এ অঞ্চলে দুর্গ-প্রাচীর, পরিখা, পোড়ামাটির নিক্ষেপাস্ত্র পাওয়া যায় যা প্রমাণ করে এখানে একটি শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল। উয়ারী যেন প্রাচীন জনপদ বলা হয়ে থাকে, প্রায় ২৫ লাখ বছর আগে মানুষ সৃষ্টি হয়েছিল; ২৪ লাখ ৯০ হাজার বছর মানুষ বনবাদাড়ে ঘুরে জীবিকা নির্বাহ করেছে যাকে বলে ‘প্রাগৈতিহাসিক যুগ’। উয়ারী-বটেশ্বরে প্রাগৈতিহাসিক হাতিয়ার পাওয়া গিয়েছে কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক বসতির চিহ্ন এখনো পাওয়া যায়নি; এ নিয়ে গবেষণা চলছে। মানব সভ্যতার সময়কাল খুব কম। মাত্র ১০ হাজার বছর আগে বর্তমান ইরাক, ইরান, মিসর, ফিলিস্তিনের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে কৃষির উদ্ভব ঘটেছিল বলে ধরা হয়। ভারতবর্ষে কৃষির উদ্ভব ঘটেছিল আরো পরে। কৃষির উদ্ভাবনের পর একটি পর্যায়ে শুরু হয়েছিল নগর সভ্যতা। উপমহাদেশের হরপ্পা সভ্যতা খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ২৭০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ পর্যন্ত টিকে ছিল। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ১৬০০ খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ অব্দ পর্যন্ত উপমহাদেশে কোনো নগর গড়ে ওঠার প্রমাণ পাওয়া যায় না। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ১৬০০-৭০০ অব্দ পর্যন্ত উপমহাদেশে গ্রামীণ সমাজ কাঠামো বিদ্যমান থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। অর্থাৎ প্রথমে নগরায়ন ঘটলো তারপর আবার গ্রামীণ সমাজ। দ্বিতীয় নগরায়ন ঘটে ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ সময়কালে। সম্প্রতি উয়ারী-বটেশ্বরে গর্তবসতির চিহ্ন আবিষ্কার হয়েছে যা দ্বিতীয় নগরায়নপূর্ব সময়কালের। সময়কাল নির্ধারণের জন্য পরীক্ষাগারে নমুনা পাঠানো হয়েছে। উপমহাদেশে অন্যান্য স্থানে গর্তবসতির সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৭০০। এছাড়াও ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রার একটি শ্রেণী পাওয়া যায় যাকে জনপদ সিরিজের মুদ্রা বলা হয়; এ ধরনের মুদ্রার আবিষ্কার উয়ারী-বটেশ্বরে একটি জনপদের অস্তিত্বের কথা ঘোষণা করে। প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে এখানে মানববসতির বিভিন্ন চিহ্ন পাওয়া যায়। উয়ারী-বটেশ্বরে চালাবাইদ ভূমিরূপের বাইদ অংশের ল্যটেরাইটিক তলের ওপর নদীবাহিত সঞ্চিত পলল চাষাবাদের জন্য খুবই উপযোগী যা বসতি গড়ে ওঠার পেছনে জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করে। জাতিতাত্ত্বিক গবেষণায় উয়ারী-বটেশ্বরে এখনো কাদামাটির ঘর দেখা যায়। ৫০-৬০ সেন্টিমিটার পুরু এসব ঘরের দেয়াল আবহাওয়ার চরমভাবাপন্নতা থেকে সুরক্ষা দেয়। ২০০০ সালের পরীক্ষামূলক খননে কাদামাটির তৈরি পড়ে যাওয়া ঘরের দেয়ালসদৃশ কিছু অংশ উন্মোচিত হয়। উয়ারী-বটেশ্বরে বর্ষাকালে ২৩৫৫ মিলিমিটার, শীতকালে ৮৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি জমা হয় যা শুষ্ক মৌসুমে পানির চাহিদা পূরণ করে। পানি ধারণ এবং তা সংরক্ষিত হওয়ার ফলে এ এলাকায় বসতি গড়ে ওঠার যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায়। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক দিলীপ কুমার চক্রবর্তী সম্প্রতি উয়ারী দুর্গ-নগরীকেই ওই জনপদের রাজধানী মনে করেন। ড. সুফি ও তার প্রজন্মরা উয়ারী সভ্যতাকে উন্মোচন করতে প্রয়োজন শক্ত রকমের প্রযুক্তি। সেই সঙ্গে দরকার জনবল ও অর্থ। এর সবগুলোর সমন্বয় ঘটিয়ে বর্তমানে একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছেন প্রফেসর ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সুফি তার একঝাঁক ছাত্রছাত্রী নিয়ে রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন প্রাচীনকে জানার। তাদের গাইতি, কর্নি বা ব্রাশের ছোঁয়ায় এখান থেকে একে একে বের হতে থাকে মূল্যবান সব প্রতœনিদর্শন। চিরাচরিত প্রথা ভেঙে এ দলটি কাজ করছে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। এ পদ্ধতির নাম মাল্টিডিসিপ্লিনারি পদ্ধতি। দেশের বিশিষ্ট ভূ-তত্ত্ববিদ, ভূগোলবিদ, রসায়নবিদ, ধাতববিদ্যা বিশেষজ্ঞ, স্থপতিসহ অনেক গবেষক ইতিমধ্যে উয়ারী-বটেশ্বরের গবেষণা কাজে অংশ নিচ্ছেন। একটা প্রাচীন সভ্যতা উন্মোচনের জন্য দরকার বিভিন্ন ধরনের বিশেষজ্ঞ। কারণ ভূগর্ভস্থ মাটির নিচে প্রাপ্ত ইটের দেয়াল পরীক্ষার কাজ কিন্তু একজন প্রতœতত্ত্ববিদের নয়। এ কাজটুকু করবেন একজন আর্কিটেকচার। আবার মাটির নিচে চাপা পড়া অনেক প্রাণীর ফসিল পরীক্ষার জন্য দরকার হয় প্যালিয়নটলজিস্টদের। এ রকম বিভিন্ন পর্যায়ের গবেষণার ফলই হলো পুরনোকে নতুনের মাঝে উন্মোচিত করা। সবচেয়ে বড় কথা হলো এ দেশে প্রতœতাত্ত্বিক গবষণায় একটা বড় রকমের কেন্দ্র পরিণত হয়েছে এ উয়ারী-বটেশ্বর। হানিফ পাঠান থেকে হাবিবুল্লা পাঠান উয়ারী-বটেশ্বরে প্রাচীন প্রতœনিদর্শন আবিষ্কারের পুরো কৃতিত্বটাই কিন্তু পাঠান পরিবারের। মরহুম হানিফ পাঠান অসাধারণ দূরদর্শী প-িত ছিলেন। ১৯৩৩ সালে তিনি মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় প্রথম ‘প্রাচীন মুদ্রা প্রাপ্তি’ শীর্ষক সংবাদ প্রেরণের মাধ্যমে উয়ারী-বটেশ্বরকে আলোচনায় নিয়ে আসেন। হানিফ পাঠান বিগত শতকের চল্লিশের দশকে যেভাবে উয়ারী-বটেশ্বরকে উপলব্ধি করেছিলেন আজকের দিনে এমন অনেকে আছেন যারা তা উপলব্ধি করতে অসমর্থ। উয়ারী-বটেশ্বর প্রতœতত্ত্ব নিয়ে পাঠান পরিবারের অবদান অপরিসীম। হানিফ পাঠানের বড় সন্তান হাবিবুল্লা পাঠান একজন স্কুল শিক্ষক হয়েও বড় মাপের স্বশিক্ষিত প্রতœতাত্ত্বিক। shimantodipu@yahoo.co.uk Src: http://taiyabs.com/2008/09/2219 Collected Articles