অরাজকতা ও দুর্নীতির কবলে টেলিযোগাযোগ Rumi, December 2, 2011 বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেড বিটিসিএলসহ সংশ্লিষ্ট গোটা খাতেই চলছে নজিরবিহীন অরাজকতা ও দুর্নীতি। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী ব্যক্তি ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তার কারণে এই খাত থেকে লোপাট হয়ে যাচ্ছে শত শত কোটি টাকা। বিটিসিএলের আন্তর্জাতিক কল রেকর্ড মুছে দিয়ে চলছে হরিলুট। অপ্রতিরোধ্য অবৈধ ভিওআইপির মাধ্যমে লুট হচ্ছে সরকারের রাজস্ব ও বৈদেশিক মুদ্রা। টেলিযোগাযোগ সংক্রান্ত বিভিন্ন লাইসেন্স দেয়াসহ অন্যান্য খাতেও চলছে বেশুমার অনিয়ম। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কারণে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি), বিটিসিএলসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। তারা বলছেন, এ ধরনের অরাজকতা চলতে থাকলে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী এই খাতটিও রুগ্ণ হয়ে পড়বে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু বলেন, নিয়মনীতির মধ্যেই চলছে টেলিযোগাযোগ খাত। এই খাত থেকে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় করছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বিটিসিএল শতভাগ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠান—যা স্বাধীনতার পর থেকে লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখে আসছে। প্রতি বছরই জাতীয় বাজেটে বিটিসিএলের আয় রাজস্ব আয়ের বড় একটি খাত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত থাকে। এই আয়ের শতকরা ৬০ ভাগের বেশি আসে আন্তর্জাতিক কলের মাধ্যমে বৈদেশিক টেলিযোগাযোগ থেকে। কিন্তু চরম দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতার কারণে সম্ভাবনাময় এই খাত থেকে দেশ হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা এবং সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব। এমনকি বিটিসিএল সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান হলেও টেলিযোগাযোগ নীতিমালা ভঙ্গ করে সরকারের রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠান বিটিআরসির সঙ্গে অদ্যাবধি কোনো রাজস্ব অংশীদারিত্ব করেনি। জানা গেছে, আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ব্যবসার নিয়ম অনুযায়ী আন্তর্জাতিক কল আদান-প্রদানের জন্য বিদেশি টেলিকম কোম্পানির সঙ্গে ভয়েস কল লেনদেনে চুক্তি হয়। নিয়ম অনুযায়ী বিদেশি কোম্পানি প্রতি মিনিট ভয়েস কলের জন্য নির্ধারিত ডলার রেট অর্থাত্ প্রতি মিনিটের বিপরীতে ৩ সেন্ট হিসেবে বিটিসিএলকে বৈদেশিক মুদ্রায় ভয়েস কলের মূল্য পরিশোধ করে। বিটিসিএলের পলিসি অনুযায়ী বিদেশি কোম্পানির কাছে জামানত হিসেবে ইউএস ডলারে মূল্য পরিশোধের ব্যাংক গ্যারান্টি নেয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশী কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সরকারের প্রভাবশালী কিছু মন্ত্রী ও আমলার সহযোগিতায় বিদেশি কোম্পানি সেজে বাংলাদেশে বসে এই ব্যবসা পরিচালনা করছে। তারা ইউএস ডলারে ব্যাংক গ্যারান্টি না দিয়ে স্থানীয় মুদ্রায় ব্যাংক গ্যারান্টি দিচ্ছে। ফলে দেশ শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সম্প্রতি এরকম ২৬ কোটি টাকার ভুয়া ব্যাংক গ্যারান্টি দেয়ার দায়ে সোনালী ব্যাংক বাড্ডা শাখার ম্যানেজারকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। বিটিসিএলের রাজস্ব ফাঁকির পাশাপাশি ব্যাপক হারে অবৈধ ভিওআইপি হচ্ছে। সম্প্রতি ইউরোপভিত্তিক ভিওআইপি নিশ্চিতকারী কোম্পানি মিউচি সলিউশনের হিসাব অনুসারে, বর্তমানে ৪৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ কলই আসছে অবৈধ ভিওআইপি পন্থায়। সর্বশেষ ২৩ অক্টোবর থেকে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ৮০ হাজার নমুনা কলের মধ্যে ৩৫ হাজার ৮৬৪টি কলই অবৈধ বলে প্রমাণিত হয়েছে। প্রতি মিনিট ইনকামিং আইএসডি কলে তিন সেন্ট করে রাজস্ব পাওয়ার কথা বিটিসিএলের। এক্ষেত্রে কয়েক কোটি মিনিট কল অবৈধ পথে আসায় সরকার দৈনিক কমপক্ষে ১০ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারাচ্ছে বলে বিটিসিএলের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। মিউচি’র তথ্যমতে, গত ১৯ মাসের মোট ইনকামিং আইএসডি কলের ৩৫ দশমিক ৬৯ শতাংশই অবৈধ পন্থায় এসেছে। গত বছরের ১১ মে থেকে এ বছরের ২২ নভেম্বর পর্যন্ত ইনকামিং আইএসডি কলের ওপর দৈবচয়ন পদ্ধতির জরিপের মাধ্যমে এ তথ্য পেয়েছে তারা। মিউচি’র হিসাব অনুসারে দৈবচয়ন পদ্ধতির ১৫ লাখ ২০ হাজার নমুনার মধ্যে ৫ লাখ ৩৪ হাজার ৪২৯টি কলই দেশে এসেছে অবৈধ পন্থায়। অবৈধ পথে আসা এই ইনকামিং কলের ৩ লাখ ১৬ হাজার ৪০৮টিই আবার এসেছে রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটক সিমের মাধ্যমে। অবৈধ কল আসার রুট হিসেবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে অপর রাষ্ট্রায়ত্ত ল্যান্ডফোন কোম্পানি বিটিসিএলের আন্তর্জাতিক গেটওয়ে। বিটিসিএলের একটি চক্র আবার গেটওয়ের তথ্য মুছে দিয়ে সরকারি রাজস্ব লুটে নিচ্ছে। টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনও স্বীকার করেছে, অবৈধ কলের সংখ্যা বেড়েছে। বিটিআরসি বলছে, বৈধ আন্তর্জাতিক কলের পরিমাণ দেড় বছর আগের চেয়েও এখন কম হচ্ছে। বাংলাদেশী অসাধু ব্যবসায়ীদের এই চক্রটি শুধু বৈদেশিক মুদ্রা থেকেই সরকারকে বঞ্চিত করছে না, বিভিন্নভাবে বিটিসিএলের শত শত কোটি টাকা রাজস্ব লোপাট করছে। এতে সহযোগিতা করছে খোদ ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন রাজু ও তার সিন্ডিকেট। অভিযোগ রয়েছে, এই সিন্ডিকেটের সক্রিয় সদস্যের অন্যতম হলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব। তার সঙ্গে আছেন বিটিসিএলের একজন প্রভাবশালী সদস্য ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একাধিক ব্যক্তি। গত মঙ্গলবার টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বলা হয়েছে, প্রতিদিনই দেশে বিদেশ থেকে আসা কলের সংখ্যা ক্রমে বাড়তে থাকলেও সরকারি রেকর্ডে তা কমেই চলেছে। গায়েব হয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক কলের রেকর্ড। কিছুদিন আগে প্রতিদিন দেশে গড়ে আন্তর্জাতিক কলের সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৫০ লাখ মিনিটেরও বেশি। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৭০ লাখ মিনিটে। মাঝে মধ্যে তা ১ কোটি ১০ লাখ মিনিটে গিয়ে ঠেকে। অথচ বর্তমানে দেশে বৈধ ও অবৈধপথে আন্তর্জাতিক কল ৫ কোটি মিনিটেরও বেশি। এসব কলের রেকর্ড গায়েব হচ্ছে একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ও অবৈধ ভিওআইপির মাধ্যমে। এতে জড়িত রয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাসহ টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা। এখান থেকে তারা হাতিয়ে নিচ্ছেন শত শত কোটি টাকা। গত ২২ নভেম্বর সংসদ সচিবালয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বলা হয়েছে, কয়েক মাস আগে বিটিসিএলের আইটিএক্স বিভাগের জিএমসহ ৮ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়। বদলির আগে দেশে আন্তর্জাতিক কলের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। তাদের বদলির পরপরই আন্তর্জাতিক কলের সংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। বৈঠকে বলা হয়েছে, কলের সংখ্যা নিয়ে লুকোচুরির পাশাপাশি ভয়াবহ তথ্য হচ্ছে, প্রায় অর্ধেক আন্তর্জাতিক কল হিসাবের বাইরে রাখা বা রেকর্ড থেকে মুছে ফেলা হয়। বৈঠকে বিটিসিএলের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সাঈদ খান দুর্নীতির বিষয়ে সংসদীয় কমিটির হস্তক্ষেপ কামনা করেন। তিনি বলেন, এখনই এসব বন্ধ করা না হলে ভবিষ্যতে সেটা কারও জন্যই সুখকর হবে না। তার বক্তব্যকে সমর্থন করেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব সুনীল কান্তি বোস। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিটিসিএলের একজন প্রভাবশালী সদস্য যিনি দুর্নীতি ও একটি হত্যা মামলায় আসামি হয়েও রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা বলে প্রত্যাহার করিয়ে নিয়েছেন—তার ছত্রছায়ায় বিটিসিএলের মহাখালী আন্তর্জাতিক এক্সচেঞ্জের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীরা আন্তর্জাতিক কলের রেকর্ড মুছে দিচ্ছে। ফলে বিটিসিএল যে বিল পাওয়ার কথা, প্রতিষ্ঠানটি তা পাচ্ছে না। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিদিন কল ভলিউম প্রতিবেদন দেয়ার কথা থাকলেও মহাখালী আন্তর্জাতিক এক্সচেঞ্জের কোনো প্রতিবেদন জমা দেয়া হয় না। মাঝে মধ্যে গোঁজামিল দিয়ে প্রতিবেদন দেয়। যান্ত্রিক ও কারিগরি ত্রুটির অভিযোগে প্রায়ই এর ডেটা রেকর্ড পাওয়া যায়নি বলা হয়। গ্রাহক পর্যায়ে বিটিসিএলের বিল মুছে দেয়ার ঘটনা নতুন নয়। তবে পার্থক্য হলো একটি টেলিফোন নম্বরের বিল মুছলে ক্ষতি হয় কয়েক হাজার, বড় জোর লাখ টাকা। কিন্তু আন্তর্জাতিক এক্সচেঞ্জের কল রেকর্ড মুছে ফেললে দেশের ক্ষতি হয় শত শত কোটি টাকা। জানা গেছে, বিটিসিএলের আন্তঃসংযোগ দেয়ার জন্য বাংলাদেশীরা বেশ কয়েকটি কোম্পানি খুলেছে। যার বেশিরভাগ কোম্পানিই ভুয়া এবং কিছু কিছু কোম্পানি খোলা হয়েছে শুধু বিটিসিএলের আন্তঃসংযোগ করে লাভবান হওয়ার উদ্দেশে। এসব কোম্পানি রাজনৈতিক তদবিরের মাধ্যমে বিটিসিএলে সংযোগ নিয়ে দিনের দিন বিভিন্নভাবে রাজস্ব ফাঁকি দিতে থাকে। জানা গেছে, এসব ক্যাপাসিটির সংযোগের নেপথ্যে রয়েছে স্বয়ং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন, প্রধানমন্ত্রীর একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টার ছেলে, ডাক ও টিলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির প্রভাবশালী ব্যক্তির ছেলে, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির একজন সদস্যসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রী, এমপি ও আওয়ামী লীগ উপদেষ্টামণ্ডলীর একাধিক সদস্য। এসব প্রতিষ্ঠান প্রতিটি বিলের বিপরীতে আপত্তি তুলে ৫ থেকে ১০ শতাংশ বিল কম দিচ্ছে, যা কখনই নিষ্পত্তি হচ্ছে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরা যথাসময়ে বিল পরিশোধ করে না, বিলের পাহাড় গড়ে তোলে। ব্যাংক গ্যারান্টির কয়েকগুণ অতিরিক্ত বিল পরিশোধ না করে অফিস-আদালত ফেলে চলে যায়। বিটিসিএলের আন্তর্জাতিক অঞ্চলের যথাযথ অডিট করা হলে বিগত তিন বছরে শত শত কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতির তথ্য বের হয়ে আসবে। জানা গেছে, শুধু গ্রামীণফোনের সঙ্গে বিটিসিএলের কয়েক মাসের বিলের পার্থক্য হয়েছে প্রায় ২৬ কোটি টাকা। যা মোট রাজস্বের মাত্র ২০ শতাংশ। অর্থাত্ গ্রামীণফোনের কল ভলিউমের জন্য বিটিসিএলের মোট রাজস্ব ক্ষতি প্রায় ১৩০ কোটি টাকা। সব অপারেটর এবং বিগত দুই বছরের হিসাব টানলে ক্ষতি হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। বিটিসিএলের ইতিহাসে এমন নজিরবিহীন দুর্নীতির ঘটনা আগে দেখা যায়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্যমতে, ইন্টারন্যাশনাল টেরিস্ট্রিয়াল ক্যাবল (আইটিসি) লাইসেন্স নিয়ে ব্যাপক রাজনীতি হচ্ছে। লাইসেন্সের গাইডলাইনের শর্ত ভঙ্গ করে সরকার ৩টির স্থলে ৬টি আইটিসি লাইসেন্স দিয়েছে। কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে দেশ-বিদেশের প্রভাবশালী মহলের চাপে সরকার অধিকসংখ্যক লাইসেন্স দিয়েছে। তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির চাপে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর এক সিদ্ধান্তে মার্কিং সিস্টেমকে প্রভাবিত করে ৩টির জায়গায় ৬টি লাইসেন্স দেয়া হয়। বেশিসংখ্যক লাইসেন্স দেয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে টেলিযোগাযোগমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, এতে প্রতিযোগিতা বাড়বে। যার ফলে গ্রাহকরা সাশ্রয়ীমূল্যে সেবা পাবেন। বাস্তবে এমন দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এ ধরনের লাইসেন্সের আওতায় সৃষ্ট পরিসেবা বাবদ ফি সংশ্লিষ্ট অপারেটরদের সরকার নির্ধারিত অভিন্ন হারেই গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করতে হবে। এতে কম-বেশি করার সুযোগ নেই। লাইসেন্সপ্রাপ্ত কোম্পানিগুলোর প্রোফাইল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ৬টি কোম্পানির সঙ্গেই ক্ষমতাসীন দলের কোনো কোনো রাজনীতিবিদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। শোনা যাচ্ছে সামিট কমিউনিকেশনকে এই লাইসেন্স দেয়ার জন্য দেয়ার জন্য তিনটির স্থলে ৬টি লাইসেন্স দেয়া হয়। আইটিসি লাইসেন্স পাওয়া ওয়ানএশিয়া নামের কোম্পানির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভীর ছোট ভাই সরাসরি জড়িত আছেন। বিডিলিংক নামের কোম্পানির সঙ্গে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কয়েকজন জড়িত। ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) অপারেটর ম্যাংগো টেলিসার্ভিসও একটি আইটিসি লাইসেন্স পেয়েছে। জানা গেছে, এ প্রতিষ্ঠানের দুই শীর্ষব্যক্তি মীর মাসুদ ও আবদুল মান্নান ঢাকা ক্লাবে মন্ত্রীর প্রতিদিনের আড্ডার সঙ্গী এবং সব সফরে মন্ত্রীর সফরসঙ্গী। মন্ত্রীর বহু অপকর্মের সঙ্গী মাসুদ ও মান্নানের প্রতিষ্ঠান ম্যাঙ্গোকে শিগগিরই এনটিটিএন ও ওয়াইম্যাক্স লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে। টেলিফোন সেক্টরে প্রচলিত আছে যে, মন্ত্রীর সঙ্গে ম্যাঙ্গো টেলিকমের শীর্ষ দুই ব্যক্তির এতোই সখ্য যে, তাদের মোবাইল ফোনের লাইসেন্স দেয়াও অস্বাভাবিক নয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর টেলিযোগাযোগ খাতে আইটিসি লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী এক ব্যক্তির নির্দেশনায় সবকিছু উপেক্ষা করে চরম অস্বচ্ছতার আশ্রয় নিয়ে এসব লাইসেন্স প্রদানে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। আইআইজি লাইসেন্সপ্রাপ্ত আরও দুই কোম্পানি নোভোকম ও ফাইভারএটহোমের সঙ্গেও একাধিক মন্ত্রীর সখ্য রয়েছে। সরকারের যথাযথ নীতির অভাব ও দুর্নীতির কারণে নব্বইয়ের দশক থেকে এক শ্রেণীর প্রভাবশালী ও অসাধু ব্যবসায়ী বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ খাত থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাত্ করে আসছে। প্রভাবশালীদের চাপে বিগত সরকারগুলো এ নিয়ে সঠিক নীতি হাতে নিতে পারেনি। যার সুযোগ বরাবরই নিয়ে আসছে ব্যবসায়ীরা। বাজারের আকার ও পরিমাপের ভিত্তিতে সঠিক নীতিমালা গ্রহণ এবং তার প্রয়োগই টেলিযোগাযোগ খাতে যথাযথভাবে অবকাঠামোগত উন্নয়নে সাহায্যে করবে। অন্যথায় অবকাঠামোতে বিচ্ছিন্নভাবে বিনিয়োগ হলে তা টেলিযোগাযোগ খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। জানা যায়, বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের নেতানেত্রীরা বিদেশে বসে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্লোগান তুলে এসব নীতি নির্ধারণে ভূমিকা রাখছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সঙ্গে অনেকেই ভিওআইপি টেকনোলজি উন্মুক্তকরণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ভয়েস খাত উন্মুক্ত করার যুক্তি দেখাচ্ছে। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রায় সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্বের ক্ষতির দিকটি তারা আড়াল করে রাখে। কারণ, তারা তাদের চলমান লুটপাট বাণিজ্যিকে ভিওআইপি টেকনোলজি উন্মুক্তকরণের মাধ্যমে একটি আইনি আবরণের আওতায় আনতে চাইছে। বিগত ২০ অক্টোবর বিটিআরসির ওয়েবসাইটে সরকার নতুন আইজিডব্লিউ, আইআইজি এবং আইসিএক্স লাইসেন্স প্রদানের গাইডলাইন প্রকাশ করেছে। সেখানে আগামী ৮ ডিসেম্বরের মধ্যে আবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু লাইসেন্স কয়টি দেয়া হবে, তা স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। রাজনৈতিক চাপে এবং দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে প্রয়োজনের তুলনায় অধিকসংখ্যক লাইসেন্স দেয়া হলে একটি দুর্নীতির মাধ্যমে আরও অনেক অনিয়মের সূত্রপাত হবে। এসব লাইসেন্স দেয়ার পর সরকার ড্রাফট লাইসেন্সিং গাইডলাইন প্রকাশ করেছিল এবং সেখান স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব মহলের সঙ্গে বসে তাদের মতামত গ্রহণ করেছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি , চূড়ান্ত গাইডলাইনে স্টেকহোল্ডারদের মতামতের সামান্যতম প্রতিফলনও হয়নি। আইজিডব্লিউ, আইআইজি এবং আইসিএক্সের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক কল টার্মিনেশনের জন্য ভিওআইপি সার্ভিস প্রোভাইডার (ভিএসপি) নামের একটি লাইসেন্সও দেয়া হবে, যা শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া হবে বলে শোনা যাচ্ছে। এ ধরনের লাইসেন্স বিশ্বের অন্য কোনো দেশে প্রচলিত নয়। ফলে আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ অঙ্গনেও বাংলাদেশকে নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে বর্তমান টেলিকম পলিসি, বাজার ও টেকনোলজির সমন্বয় ঘটিয়ে স্বচ্ছতার মাধ্যমে লাইসেন্স দেয়ার উদ্যোগ নেয়া উচিত। যদিও শোনা যাচ্ছে আইটিসি লাইসেন্সের মতো দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে এবং দেশ-বিদেশে অবস্থানকারী প্রভাবশালী ব্যক্তিদের চাপে পূর্বনির্ধারিত কিছু প্রতিষ্ঠানকে এসব লাইসেন্স দেয়া হবে। ভিএসপি লাইসেন্স দেয়ার মাধ্যমে সরকার বর্তমানে প্রাপ্ত আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ রাজস্বের ৫ শতাংশ উল্লিখিত লাইসেন্সধারীদের দেয়ার নীতিমালা পাস করেছে। বিটিসিএলের আন্তর্জাতিক কল রেকর্ড মুছে ফেলার বিষয়টি স্বীকার করে বিটিসিএলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সদস্য বলেন, এসব বিষয়ে তারা সংসদীয় কমিটিসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে উত্থাপন করেছেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সরকার এসব বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব সুনীল কান্তি বোস জানান, ভিআইপি বন্ধে তারা ১০ সদস্যের একটি শক্তিশালী কমিটি করছেন। বিটিআরসি’র স্পেকট্রাম বিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবিব খানকে প্রধান করে এ কমিটি গঠন করা হবে। বিশেষ কমিটিতে বিটিআরসির তিনজন প্রতিনিধি, মন্ত্রণালয়ের দু’জন এবং দু’জন বিশেষজ্ঞ থাকবেন। এ কমিটি ভিওআইপি কল কীভাবে প্রতিরোধ করা যায় সে ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দেবে। টেলিযোগাযোগ খাতে অস্থিরতা ও দুর্নীতি প্রসঙ্গে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমদ রাজু বলেন, ‘যা কিছু হচ্ছে তা সবই আইন মেনে নীতিমালার আলোকেই হচ্ছে। এর বাইরে কোনো কিছু বলতে তিনি রাজি হননি।’ ভিওআইপিসহ কিছু অনিয়মে টেলিযোগাযোগমন্ত্রী ও তার ঘনিষ্ঠজনদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি নিজেও এ অভিযোগ শুনেছি। তবে এটি সম্পূর্ণ গুজব ও মিথ্য। যদিও আমি জানি আমার মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত যাবতীয় অভিযোগের জন্য মন্ত্রী হিসেবে আমাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। সব জায়গায় ভালো-খারাপ মিশিয়ে লোকজন থাকে। দেশ ও সরকারের ক্ষতি হয়, এমন কাজ কেউ করলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ Src: http://www.amardeshonline.com/pages/details/2011/12/01/120318 Collected Articles Uncategorized Thoughts